রামপুরা এলাকায় টিসিবির ট্রাকের লাইনে কথা হয় মামুনুর রহমান নামে এক ক্রেতার সঙ্গে। পেশায় তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন রামপুরা এলাকাতেই। পরিবারের সদস্য সংখ্যা চারজন। টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়েছেন চাল, ডাল আর সয়াবিন তেল কিনতে।

তার কথায়, একটা সময় ছিল তিনি পাঁচ লিটারের বোতল কিনতেন। এখন সেই সামর্থ্য নেই। তাই টিসিবির ট্রাক থেকে এখন দুই লিটারের বোতল কেনেন। সঙ্গে পাঁচ কেজি চাল আর দুই কেজি ডাল কেনেন। এই মোটা ডাল আগে কিনতেন ৫০ টাকায়। এখন সেটা ৬৫ টাকা। খুচরা বাজারে এটা ৯০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম ১৬৫ টাকা লিটার। টিসিবির ট্রাকে এর দাম ১১০ টাকা। তাই তিনি এখান থেকেই কিনছেন। তিনি জানান, মাসিক আয়ের অর্ধেক চলে যায় ঘর ভাড়ায়।

এরই মধ্যে ঘরের মালিক ভাড়া বাড়ানোর নোটিস দিয়েছেন। মার্চ থেকে হয়তো আরও ৫০০ টাকা বেশি গুনতে হবে। বেড়েছে পরিবহন খরচ। মামুনুর রহমান বলেন, আগে প্রতি শুক্রবার মুরগির মাংস আর এক দিন মাছ কিনতেন। এখন বাধ্য হয়ে তিনি মাছ কেনা ছেড়ে দিয়েছেন। সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবার বয়লার মুরগি কিনে বাচ্চাদের খাওয়ান। বাকি দিনগুলো ডাল, ভর্তা আর সবজি দিয়ে কোনোরকমে চালিয়ে নিচ্ছেন।

কেননা সবজির বাজারও বেজায় চড়া। এ রকম হাজারো মামুনুর নীরবে নিভৃতে দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে জর্জরিত। জীবন-জীবিকার জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে তেমন কোনো মনিটরিং না থাকায় ইচ্ছমতো দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে শীতের ভরা মৌসুমেও সবজির দাম কমেনি। সয়াবিন তেল, আটা, আর ও চিনির বাজার তো পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে। রসুন, পিঁয়াজের দাম কিছুটা কমতি থাকলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এটা অনেক বেশি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো মনিটরিংয়ে নেই বললেই চলে।

হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি অভিযান ছাড়া তেমন কোনো কার্যক্রম নেই বাজার মনিটরিংয়ে নিযুক্তদের। অথচ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী বা দফতরের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি, এমনকি খোদ অর্থমন্ত্রী কয়েক দিন আগে সাংবাদিকদের বলেছেন, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। দেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করেছে। যার ফলে বাজারে কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা হচ্ছে দায় এড়ানোর বক্তব্য।

করোনার মধ্যেও দেশের মানুষের আয় ৩ হাজার ডলার অতিক্রম করেছে। কিন্তু এটা কতভাগ মানুষের? বেশির ভাগ মানুষেরও তো আয় কমেছে। ফলে আয় বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নিতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানও। এদিকে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গতকালও প্রতিকেজি টমেটো ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শিমের কেজি এখনো ৪০-৬০ টাকা।

বরবটির কেজি ১৫০ টাকা। ছোট্ট একটি ফুলকপি কিনতে গুনতে হচ্ছে ৩০-৪০ টাকা। একটি লাউ ৬০-১২০ টাকা। চারটি লাউয়ের ডগা ৪০ টাকা। পাঁচ থেকে ছয়টি পুঁইশাকের ডগার দাম ৩০ টাকা। এক মুঠো পালং কিংবা সরিষা শাকের দাম ২০ টাকা। ডিমের ডজন বহু আগেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে, যা এখন ১২০ টাকা। বছরখানেক আগেও দুই কেজি আটার প্যাকেজের দাম ছিল ৬৫ টাকা, এখন সেটা ৯০ টাকা। এক কেজি লাল চিনির দাম ছিল ৭৫ টাকা, মাস তিনেক আগে সংকট দেখা দিলে সরকার চিনির মূল্য ৮৫ টাকা বেঁধে দেয়।

কিন্তু কোথাও এ দামে চিনি পাওয়া যায় না। লাল চিনির কেজি এখন ৯৫ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা ১০০ টাকা। আর সাদা চিনির কেজি ৮৫-৯০ টাকা। অথচ সরকারের গুদামে লাল চিনি অবিক্রীত রয়ে গেছে, যা বিক্রি হচ্ছে না। সয়াবিনের বাজার আদৌ স্থিতিশীল হবে কিনা? আমাদের কৃষিপণ্যগুলোর দাম অত্যন্ত চড়া হওয়ার কারণ কী হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘আপনারা এ ব্যাপারে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করুন। সাপ্লাই চেইনের বিষয়গুলো জনগণের সামনে নিয়ে এলে কাজ করতে সুবিধা হবে।’

বাজার মনিটরিং টিমগুলো কাজ করছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজ করছে, তারপরও অনেক কিছু করা যায় না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আপনি জোর করে কিছু করতে পারবেন না। আর কাঁচা জিনিস শাক-সবজির কোনো নির্ধারিত মূল্য নেই। এটা মনিটরিং করা খুব কঠিন। মনিটরিং করা যায় যেটার গায়ে মূল্য লেখা থাকে।’ চিনির দাম ৮৫ টাকা মানা হচ্ছে না প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কোন দোকান এটা করছে- তার নামধাম দিয়ে এটা ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করুন।’ পণ্যমূল্যের বিষয়ে সন্তুষ্ট না হলে সাধারণ মানুষকে ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করার পরামর্শ দেন সরকারের এই সিনিয়র সচিব।

অভিযোগ অনুযায়ী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং জেলায় জেলায় থাকা সরকারের বাজার মনিটারিং টিমগুলো শুধু রমজানের সময় কিছুটা আওয়াজ দিয়ে নড়াচড়া করে। এ ছাড়া সারা বছর সেগুলোর তেমন কোনো কার্যক্রম থাকে না। করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয় কমেছে, কিন্তু বেড়েছে সব ধরনের জীবন-যাত্রার ব্যয়।

জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন খরচও বেড়েছে। এদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। অন্যদিকে ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে। আমদানিকারক ও ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে সয়াবিনের দাম ১২০০ ডলার থেকে দেড় হাজার ডলারে উঠেছে। যার ফলে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া ডলারের দাম বেশি।

ফলে তারও একটা প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া ভোজ্য তেলের ওপর সরকারের তিন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট/মূসক রয়েছে যার কারণে এখানে খরচ বেশি। এতে দাম বাড়ছে বলে তারা জানিয়েছেন। তবে চিনির দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি নেই কারও কাছে। এদিকে খোদ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।

আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, আগে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। এখন সেটা আরও ৫ শতাংশ বেড়ে ২৫ শতাংশে উঠেছে। সামনের দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কাজ দিতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাবে। এতে আমাদের সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে,

বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের ৪ কোটি পরিবার আছে। এর মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই এখন চরম সংকটে আছেন। তাদের মধ্যে বড় একটা অংশ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। অনেকেরই নিয়মিত বেতন হয়নি,

অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। চালু হলেও বেতন কমিয়ে দিয়েছে মালিকপক্ষ। আবার যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন তাদের অনেকেই এখনো কর্মহীন। একই সঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী/শ্রমজীবী মানুষেরা আরও বেশি কষ্টে রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নির্দিষ্ট (ফিক্সড) আয়ের মানুষ, যাদের গত কয়েক বছর ধরে আয় একই রকম। অথচ বিভিন্ন খাতের ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ।

 

 

কলমকথা/বি সুলতানা